সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১০ পূর্বাহ্ন
জগন্নাথপুর নিউজ ডেস্ক::
‘কী চাস তোরা? বেয়াদবি করছিস কেন?’ গর্জে ওঠে বজ্রকণ্ঠ। পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের সামনে পড়ে ঘাবড়ে যায় ঘাতক ল্যান্সার মহিউদ্দীন। কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে পিস্তল পড়ে যায়। ‘স্টপ! দিস বাস্ট্রার্ড হ্যাজ নো রাইট টু লিভ।’ গর্জে ওঠে ঘাতক নূর চৌধুরীর স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান। মাত্র সাত ফুট দূর থেকে ১৮টি গুলি এসে ঝাঁজরা করে দেয় ধ্রুবতারাটির দেহ। কৃষ্ণগহ্বরের রাতে বৃষ্টির মতো গুলিতে ঝাঁজরা ছয় ফুট দুই ইঞ্চির বিশাল দেহ মুখ-থুবড়ে পড়ে সিঁড়িতে। বুকের ডান দিকে গুলির বিরাট ছিদ্র। যে উঁচু করা তর্জনী ছিল পাকিস্তানের ভয়ের কারণ আর সন্তানসম বাঙালির আস্থার প্রতীক, ঘাতকের ব্রাশফায়ারে উড়ে যায় সেই তর্জনীটি। অবশ্য ডান হাতে আঁকড়ে ধরা ছিল ধূমপানের প্রিয় পাইপ।
আগস্ট আর বর্ষণস্নাত শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে। সেদিন শ্রাবণের বৃষ্টি নয়, আকাশের চোখে ছিল জল। গাছের পাতারা শোকে সেদিন ঝরেছে অবিরল। অভিশপ্ত দিনে হতবিহ্বল জাতির চারদিকে ছিল ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন। মুছে দিতে চেয়েছিল রক্তচিহ্নসহ জনকের লাশ। রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে থাকা দেয়াল, জানালার কাঁচ, মেঝে, ছাদের ৩২ নম্বর ধানমন্ডিকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল ইতিহাস থেকে। হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীদের বিচার না করে তাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল রাষ্ট্র।
আজ ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধূঁর শোকের দিন। পঁচাত্তরের এ দিনে কাকডাকা ভোরে বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। গভীর আবেগ ও বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি আজ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করবে। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। পৃথক পৃথক বাণীতে জাতির পিতা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে তার আদর্শের সোনার বাংলা গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
‘৩২’ নম্বরে সেদিনের চিত্র : অফিসিয়ালি আদেশপ্রাপ্ত হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটির মধ্যে প্রথমবারের মতো যান ঢাকা স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত লে. কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসি। ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান এবং না বলা কিছু কথা’ বইয়ে লিখে রেখে গেছেন সেই সময়ের কিছু তথ্য। সেখানে গিয়ে দেখতে পান বাড়ির মূল দরজায় মেজর পাশা এবং মেজর বজলুল হুদাকে। মেজর হুদা প্রথমেই তাকে নিয়ে যান নিচতলার রিসিপশন রুমে। যেখানে শেখ কামালের মৃতদেহ টেবিলের পাশে একগাদা রক্তের মাঝে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। পাশে টেবিল থেকে ঝুলছিল টেলিফোনের রিসিভার। লে. কর্নেল হামিদের মনে হয়েছিল শেষ মুহূর্তে কাউকে ফোন করতে চাইছিলেন শেখ কামাল। একটা হাত তার ওদিকেই ছিল।
লে. কর্নেল এম এ হামিদ লিখেছেন, সিঁড়িতেই পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি এবং চেক লুঙ্গি। পাশেই ভাঙা চশমা। বঙ্গবন্ধুর দেহ সিঁড়ির ওপরে এমনভাবে পড়েছিল যেন মনে হচ্ছিল সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেছেন। মুখে কোনো রকমের আঘাতের চিহ্ন ছিল না। চেহারা ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বুকের অংশটুকু ছিল ভীষণভাবে রক্তাক্ত। মনে হলো ব্রাশ লেগেছে। বঙ্গবন্ধুর বাম হাতটা ছিল বুকের উপর ভাঁজ করা, তবে তর্জনী আঙ্গুলটা ছিঁড়ে গিয়ে চামড়ার টুকরার সঙ্গে ঝুলেছিল। সারা সিঁড়ি বেয়ে রক্তের বন্যা। সিঁড়ির মুখেই ঘরটাতে অর্ধেক বারান্দায় অর্ধেক ঘরের ভেতরে বঙ্গমাতার দেহ উপুড় হয়ে পড়েছিল।
লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, কামরার মেঝেতে এক সাগর রক্ত থপথপ করছিল। আমার বুটের সোল প্রায় অর্ধেক ডুবে যাচ্ছিল। বিধ্বস্ত পরিবেশ। রক্তাক্ত কামরার মধ্যে পড়ে ছিল শেখ জামাল, রোজী জামাল, সুলতানা কামাল। তার কোল ঘেঁষে ছোট শেখ রাসেলের মৃতদেহ। তার মাথার পিছনদিক একেবারে থেঁতলে গিয়েছিল। নিচের তলার একটি বাথরুমে পড়েছিল শেখ মুজিবের ভাই শেখ নাসেরের রক্তাপ্লুত মৃতদেহ। বাড়ির পিছনে আঙ্গিনায় একটি লাল গাড়ির পেছনের ইটে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা ছিল কর্নেল জামিলের প্রাণহীন দেহ।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত অনুযায়ী, ১৫ আগস্টের নেতৃত্বে ছিল কর্নেল ফারুক। তারই পরিকল্পনায় প্রায় ১৫০ জন সৈন্যের বড় বড় তিনটি দল সাজানো হয়। তিনটি দলের প্রধান টার্গেট শেখ মুজিব, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাড়ি। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম ঘটনার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূর ও মহিউদ্দিনকে। তাদের সঙ্গে ছিল এক কোম্পানি ল্যান্সার। সেরনিয়াবাতের বাড়ি আক্রমণ করার দায়িত্ব নেয় ডালিম। আর খুনি ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন রিসালদার মুসলেহউদ্দিনকে দেয়া হয় শেখ মণির বাড়ি আক্রমণের দায়িত্ব। খুনিদের ওপর নির্দেশ ছিল সবাইকে হত্যা করার। এছাড়া খুনিদের বাধাদানকারী বা পরে বিপদের কারণ হতে পারে এমন যে কাউকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কর্নেল ফারুক। হত্যাকাণ্ডে বাধা আসতে পারে এমন স্থানেও কিছু সৈন্য মোতায়েন ও ট্যাংক প্রস্তুত করে রাখে হায়েনারা।
ভোর ৪টা ০৮ মিনিটে রক্তপিপাসু ঘাতক চক্র তিন দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৩০টি ট্যাংক অবস্থান নেয়। ভোর ৫টার মধ্যেই ঘেরাও করে ফেলে ৩২ নম্বর বাড়ি এবং আশপাশের এলাকা। আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধু ভবনে আক্রমণ করে। গোলাগুলির মধ্যে বিভিন্ন দিকে ফোন করে সাহায্য চান বঙ্গবন্ধু। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কেউ ফোন ধরছিল না। মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল ফোন পেয়ে তাৎক্ষণিক ছুটে এসে সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর কাছে সহায়তা চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার আই এম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস।’ ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিটে বৃষ্টির মতো গুলিতে ঝাঁজরা বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়েন।
কৃষ্ণপক্ষে শহীদ যারা : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন প্রাণ হারান শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, নবপরিণীতা দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশু পৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কমকর্তা ও কর্মচারী। প্রবাসে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
হত্যাকাণ্ডের বিচার : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম তখন ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিলের রায়ে এই ১৫ জনের মধ্যে তিনজন খালাস পান। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বাকি ছয়জন পলাতক থেকে যান। এর প্রায় ১০ বছর পর ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতক ছয়জনের একজন ৭২ বছর বয়সি মাজেদকে ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেরানীগঞ্জের কারাগারে ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর হয়।
Leave a Reply